কোরবানির পশুর ঘাটতি সামান্য, অর্ধেক জোগান দেবে স্থানীয় খামার

  নিউজ ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ০৯:৫৯, সোমবার, ১০ জুন, ২০২৪, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কোরবানির পশুর চাহিদা মেটাতে একসময় ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ। গত কয়েক বছর ভারত থেকে গরু আসা কমেছে অনেকটা। এতে পাল্টে গেছে চিত্র। এখন কোরবানির পশুর চাহিদা মিটছে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পশু দিয়েই। চট্টগ্রামে এবার কোরবানি পশুর ৫০ শতাংশের বেশি জোগান দিচ্ছে স্থানীয় খামারগুলো।

জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে এবার সম্ভাব্য কোরবানির পশুর চাহিদা ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে ৫ লাখ ২৬ হাজার ৪৭৫ গরু, ৭১ হাজার ৩৬৫ মহিষ, ১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৮৩ ছাগল, ভেড়া ৫৮ হাজার ৬৯২ ও অন্য পশু ৮৮টি। এর বিপরীতে কোরবানির জন্য পশুর মজুত রয়েছে ৮ লাখ ৫২ হাজার ৩৫৯টি। সব মিলিয়ে ঘাটতি ৩৩ হাজার ৪০৬টি পশুর।

প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো নজরুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রামে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩৫ হাজার খামার রয়েছে। এসব খামার থেকে অন্তত চার লাখ কোরবানির পশু বিক্রি হবে, এর বড় অংশই গরু। আমাদের হিসাবে এসব খামার চট্টগ্রামের মোট চাহিদার ৫০-৫৫ শতাংশ পূরণ করবে। বাকি ৪৫ শতাংশ স্থানীয় গৃহস্থ ও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ব্যাপারীরা জোগান দেবেন।’

তিনি বলেন, ‘আশপাশের জেলাগুলোর চেয়ে চট্টগ্রামের মানুষ বেশি কোরবানি দেন। ফলে প্রতি মৌসুমে কোরবানির পশুর ঘাটতি থাকে। চট্টগ্রামের ঘাটতি পূরণে পার্শ্ববর্তী রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় চাহিদার চেয়ে বেশি পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া প্রতি বছর দেশের উত্তরাঞ্চলের পাবনা ও কুষ্টিয়া থেকে চট্টগ্রামে কোরবানির পশু আসে। সব মিলিয়ে আমরা মনে করছি পশু ঘাটতির খুব একটা সমস্যা হবে না।’

তবে চট্টগ্রাম ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে চট্টগ্রামের স্থানীয় খামার থেকে সাড়ে তিন লাখের মতো পশু বাজারে আসতে পারে। ক্ষুদ্র গৃহস্থ ও চট্টগ্রামের বাইরে থেকে নিয়ে আসা গরু দিয়েই চট্টগ্রামের কোরবানির পশুর চাহিদার বড় অংশ পূরণ হবে। তারপরও ১৫-২০ শতাংশ পশুর ঘাটতি থাকতে পারে।

কোরবানির পশুর ঘাটতি সামান্য, অর্ধেক জোগান দেবে স্থানীয় খামার

চট্টগ্রাম ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক বলেন, ‘চট্টগ্রামে শুধু কোরবানির গরু প্রস্তুত করে এমন খামারের সংখ্যা সাড়ে তিনশ থেকে চারশ। এসব খামারে গড়ে ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০টি পর্যন্ত গরু মোটাতাজা করা হয়।’

‘এর বাইরে ১০ থেকে ৩০টি গরু মোটাতাজা করে এমন খামারের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। খামারভিত্তিক পশু লালপালনকারীদের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখের মতো কোরবানির পশু বাজারে আসবে। এছাড়া জেলার ক্ষুদ্র গৃহস্থ ও কৃষকরা প্রয়োজনীয় পশুর একটি বড় অংশ জোগান দেবেন। এর সঙ্গে যোগ হবে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের গৃহস্থদের গরু। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা আনুমানিক আরও তিন লাখ।’-বলেন ওমর ফারুক।

চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় অ্যাগ্রো ফার্ম নাহার অ্যাগ্রো। প্রতি বছর প্রতিষ্ঠানটি কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত করে। নগরের বড় ক্রেতাদের নজরও থাকে এ ফার্মের ওপর।

নাহার অ্যাগ্রোর কর্মকর্তা মনোজ কুমার বলেন, ‘আমরা এবার কোরবানি উপলক্ষে ৫০০ গরু প্রস্তুত করেছি। এর মধ্যে আশা করছি সাড়ে তিনশ থেকে চারশ গরু বিক্রি হবে।’

চট্টগ্রামের শিকলবাহা এলাকার শাহ আমানত অ্যাগ্রো ফার্মের ম্যানেজার মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘চলতি বছর আমরা ১০০টি বড় জাতের গরু তৈরি করেছি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে। আমাদের অধিকাংশ গরুর ক্রেতা নগরের শীর্ষ ব্যক্তিরা। এরই মধ্যে অনেকে গরু পছন্দ করে কিনে রেখেছেন।’

পাবনা-সিরাজগঞ্জ থেকে আসছে কোরবানির গরু

গবাদিপশু সমৃদ্ধ পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে প্রতি বছরই চট্টগ্রামের জন্য আলাদাভাবে কোরবানির পশু প্রস্তুত করা হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পশুর হাট সাগরিকা ও বিবিরহাটে এসব গরুর জন্য থাকে আলাদা সারি। মূলত চট্টগ্রামের বড় গরুর চাহিদার অনেকাংশই পূরণ হয় দেশে পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের গরু দিয়ে।

ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক বলেন, ‘চট্টগ্রামে বাজারে বিক্রির জন্য পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে গরু লালন-পালন করা হয়। এসব জেলা থেকে মূলত বড় গরু চট্টগ্রামের বাজারে আসে। তা দিয়ে চট্টগ্রামের বাজারে যেটুকু ঘটতি তা পূরণ হবে।’

কোরবানির পশুর ঘাটতি সামান্য, অর্ধেক জোগান দেবে স্থানীয় খামার

বিবিরহাটের পশু ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘কোরবানির প্রায় পাঁচমাস আগে থেকে ব্যবসায়ীরা পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়াসহ উত্তরাঞ্চল ঘুরে কোরবানির পশু কিনছেন। আবার সেখানকার ব্যাপারীরাও গরু নিয়ে চট্টগ্রামের বাজারে আসেন। এরই মধ্যে সেসব পশু চট্টগ্রামে আশা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে বর্ডার ক্রস ব্রাহমা, ক্রস ব্রাহমা, শাহিওয়াল, ইন্ডিয়ান গীর ষাঁড় অন্যতম।’

সীমান্ত থেকে আসছে গরু

চট্টগ্রাম ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে স্থানীয় খামার, গৃহস্থ ও আশপাশের চার জেলা থেকে চট্টগ্রামের মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হবে। বাকি ২০ শতাংশ পশুর জোগান কোথা থেকে আসবে সে জবাব দিতে গিয়ে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক অনেকটাই কৌশলী ভূমিকা নেন। তিনি বলেন, ‘২০ শতাংশ গরুর ঘাটতি প্রায় প্রতি বছর থাকে। তবে কোরবানির আগে সেসব পূরণ হয়ে যাবে, ঘাটতি থাকবে না।’

স্থানীয় বেশ কয়েকজন পশু ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যদিও দীর্ঘ সময় ধরে ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ। তারপরও বিভিন্নভাবে দেশের বাজারে প্রতি বছর ভারতের গরু আসছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গরু ব্যবসায়ী বলেন, ‘মে মাসের শুরু থেকে বান্দরবানের আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছ‌ড়ি সীমান্ত দিয়ে অবৈধ গরু ও মহিষ আসছে। এছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চল ও সিলেট সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করা গরুর একটি বড় অংশ চট্টগ্রামের বাজারে আসছে নানাভাবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. নরুল আবছার ইমন বলেন, ‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বাম হাতিরছড়া, ভালুখাইল্লা, কালাচাইন্দা, চাকঢালা, জামছড়ি, জারুলিয়াছড়ি, আশারতলী, ফুলতলী, দোছড়ির সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা দিয়ে চোরাকারবারিরা চোরাই গরু দেশে নিয়ে আসছেন। গভীর রাতে এসব গরু ট্রাকে কক্সবাজারের চকরিয়া, মালুমঘাট, ঈদগাহ ও রামু হয়ে চট্টগ্রামের বাজারে পৌঁছায়।’

খামারে পশু বিক্রি শুরু, ক্রেতা কম

চট্টগ্রামের হাটগুলোতে পশু বিক্রি শুরু না হলেও খামারে পশু বিক্রি শুরু হয়েছে আরও আগ থেকে। তবে অন্যবারের চেয়ে এবার বিক্রি একেবারেই কম বলছেন খামারিরা। মূলত শহরের বাসিন্দাদের পশু রাখার সুবিধা না থাকায় কোরবানির দু-একদিন আগে ছাড়া তারা পশু কেনেন না। এছাড়া স্বল্পসংখ্যক যারা কিনছেন তারা খামারেই রেখে যাচ্ছেন।

কোরবানির পশুর ঘাটতি সামান্য, অর্ধেক জোগান দেবে স্থানীয় খামার

কর্ণফুলী উপজেলার ওজি অ্যাগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী তানভীর কালাম বলেন, ‘কোরবানি আর সপ্তাহখানেক বাকি থাকলেও খামারে এখনো গরু বিক্রি জমে ওঠেনি। চলতি বছর ৪০টি গরু কোরবানির জন্য মোটাতাজা করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে মাত্র তিনটি।’

‘শুধু আমার খামার নয়। কর্ণফুলী উপজেলায় সাড়ে নয়শ রেজিস্টার্ড খামার রয়েছে। সব খামারেই একই অবস্থা বিরাজ করছে। মূলত দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় মানুষ তাড়াতাড়ি পশু কিনতে আগ্রহী হচ্ছে না। সবাই ভাবছে শেষ দিকে দাম কমবে। কিন্তু এত উচ্চমূল্যে লালন-পালন করা পশু আমরা কম দামে কীভাবে বিক্রি করবো।’ বলেন তানভীর কালাম।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পশুখাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় খামারিদের পশু লালনপালনেও বেশি খরচ হয়েছে। এ কারণে এবার বাজারে কোরবানির পশুর দাম বেশি থাকবে। আশঙ্কা করছি, পশুর দাম বেশি হলে কোরবানিও কম হতে পারে। এতে খামারিরা লোকসানে পড়বেন।’

বিষয়ঃ বাংলাদেশ

Share This Article